ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের আয়োজক কাতার: শোভা পাচ্ছে ইসলামের পরিচিতিমূলক ই-বুক, ঐতিহ্যমন্ডিত স্থাপনা ও হাদিসসংবলিত দেয়ালচিত্র
1 min read
আবু তালহা তোফায়েল :: প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক মধ্যপ্রাচ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত কাতার। বিশ্বকাপ উপলক্ষে আলোচিত স্টেডিয়াম নির্মাণে সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে, দেশটিতে আমেরিকার সামরিক ঘাটি স্থাপনা করা হয়েছে। এগুলো বাহ্যিক নিন্দনীয় কাজ হলেও কাতার বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাতিস্বত্বার পক্ষে এমনসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে, যা কথিত কোনো মুসলিম রাষ্ট্রই করেনি।
কাতার সেই রাষ্ট্র, যে সৌদি-আমিরাত জোটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুসলিম জাতিসত্বার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কাতার সেই রাষ্ট্র, যে মিশরের ব্রাদারহুড থেকে ফিলিস্তিনের হামাস পর্যন্ত মুসলিম দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। কাতার সেই রাষ্ট্র, যে বাংলাদেশ থেকে শতশত কুরআনে হাফেজদের নিয়ে তাদের মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগ দিয়ে মোটা অংকের বেতন দিচ্ছে।
“গত ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হয় বিশ্বকাপ।বিশ্বকাপ ঘিরে ইসলামের সঠিক তথ্য তুলে ধরতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কাতার সরকার। দর্শক ও ভক্তদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিতে ছয় ভাষায় ই-বুক চালু করেছে দেশটির আওকাফ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল মাহমুদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখা ই-বইয়ের লিংক প্রকাশ করে আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলাম’ নামের বইটি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, রুশ, পর্তুগিজসহ ছয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। পাশাপাশি মৌলিক আরবি ভাষা শিখতে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ‘স্পোকেন অ্যারাবিক’ নামের সংক্ষিপ্ত ই-বুক রয়েছে।
( https://binzaid.gov.qa/lang-ebook/book-fafa22.html লিংকে প্রবেশ করে যে কেউ তা পড়তে পারবে।)
–
১৩২ পৃষ্ঠার বইটিতে ১৮টি অধ্যায়ে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। প্রথম ১০টি অধ্যায়ে ইসলামের পরিচয়, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, আল্লাহর একত্ববাদ, ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ, নবী-রাসুলদের উদ্দেশ্য, আসমানি গ্রন্থ, পবিত্র কোরআন, ইসলামে মর্যাদাপূর্ণ তিনটি স্থান, কোরআনের অলৌকিকত্ব তুলে ধরা হয়। পরবর্তী আটটি অধ্যায়ে ইসলামী শিল্পকলা ও ক্যালিগ্রাফি, পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব, নারীর মর্যাদা, শিশুদের অধিকার, ইসলামে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার, ইসলাম ও সভ্যতা, মহানবী (সা.)-এর অন্তিম উপদেশ এবং জেরুজালেমে প্রবেশকালে ওমর (রা.)-এর চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
এদিকে ইসলামী শিষ্টাচার তুলে ধরতে আবদুল্লাহ বিন জাইদ আল মাহমুদ সেন্টারের উদ্যোগে দোহার বিভিন্ন স্থানে মহানবী (সা.)-এর হাদিসসংবলিত দেয়ালচিত্র দেখা যায়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে আগত দর্শক-ভক্তদের কাছে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরার উদ্যোগটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সুন্দর আচার-ব্যবহার ও পার্থিব জীবনে ভালো কাজের গুরুত্বসংক্রান্ত হাদিসগুলো আরবি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করা হয়।
তা ছাড়া দোহার কাতারা এলাকায় বিশ্বকাপ চলাকালে ইসলামের শিক্ষা ও পরিচিতি তুলে ধরতে একটি প্যাভিলিয়ন চালু করা হয়েছে। এতে ইসলাম ও আরব সংস্কৃতির পরিচিতি নিয়ে মুদ্রিত বই বিতরণ করা হবে এবং দর্শকদের কাছে তাদের ভাষায় ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা হবে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বা ভিআর প্রযুক্তির সাহায্যে দর্শনার্থীদের দেখানো হবে পবিত্র কাবাঘর, হাজরে আসওয়াদসহ মক্কা ও মদিনার ঐতিহাসিক ইসলামী স্থাপনা। (সূত্র: আলজাজিরা)
–
সম্প্রতি ফুটবল বিশ্বকাপে শ্রমিক অধিকার নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে কাতারের বিরুদ্ধে লেগেছে, তাতে দেশটির মুসলিম জাতিস্বত্বার উপর অবদানও সামনে আনার দরকার পড়ছে বলে আমি মনে করি।
তাই নিম্নে কয়েকটি দিক তুলে ধরছি:
তালেবান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে কাতার সরকার সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। যখন আমেরিকার ঘোষণামতে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি বলা হতো তালেবানদের ঠিক সেই সময় কাতার তাদের জন্য স্থায়ী অফিসের ব্যাবস্থা করে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত কাতারের মধ্যস্থতায় আমেরিকা-তালেবানের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এমনকি আফগানিস্তানের পুতুল সরকারকে হটিয়ে সংগ্রামী এই সংগঠনের সরকার গঠনের পর সারা বিশ্ব থেকে আফগানিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, তখন কাতার এয়ারওয়েজ দিয়ে সারাবিশ্বে তাঁদের যোগাযোগ চালু করে। একই সাথে তালেবানের টেকনিক্যাল টিম এসে কাবুল বিমানবন্দর দখল করে।
সৌদিআরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো ইজরায়েলের পক্ষে গেলেও কাতার একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে আরবআমিরাত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে যারা ফিলিস্তিনিদের ভিটেমাটি নির্লজ্জের মতো দখল করে আছে৷ মিশর, বাহরাইন ও সৌদিআরবও স্বীকৃতি দিতে উল্টেপড়ে আছে, কিন্তু কাতার বিপরীতে ইসরায়েলের বিপক্ষে যুদ্ধরত হামাসকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য দিয়ে আসছে। একই সাথে মিশরের মাজলুম সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডকে সাহায্য সহায়তার পাশাপাশি সংগঠনের নির্বাসিতদের নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছে।
–
আন্তর্জাতিক খ্যাত সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে কাতারের সাফল্যের অন্যতম প্রতীক মনে করা হয়। অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে মুসলিম জাতিস্বত্বাকে সুরক্ষা দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদ প্রচারে আল-জাজিরা সারা বিশ্বে নির্ভরযোগ্যে পরিণত হয়েছে। আল-জাজিরার কয়েকটি সংবাদ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদেরও কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এরকম মুসলিম উম্মাহর পক্ষে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়ায় ইসরায়েলের দুষর সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর চক্ষুশূলতায় পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট এই দেশ কাতার। এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ২০১৭ সালে সৌদিআরব, মিশর, বাহরাইন ও আরবআমিরাত একজোট হয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এসব দেশের উপর দিয়ে কাতার এয়ারওয়েজ চলাচল ও তাদের দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তখন কাতার এই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে বিমানে করে খাদ্যশস্য আমদানি করে। শেষ পর্যন্ত কাতারকে দমিয়ে রাখতে না পেরে নির্লজ্জের মতো এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। নির্যাতিত ও ক্ষুধার্ত স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সৌদির ব্যার্থতা ও কাতারের সফলতা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নিচক ভৌগলিক আয়তন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং আয়তন ও জনসংখ্যা কম হলেও নিজস্ব সম্পত্তির সৎ ব্যাবহার ও নির্যাতিত স্বজাতির দরদ যদি থাকে, তাহলে কত ব্যাপাক আকারে কাজ করা যায়। যার উদাহরণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট এই দেশ কাতার।
কাতার এখন আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যার ফলে দেখা গেছে আফগানিস্তানে আটকে পড়া আমেরিকার বাহিনী ফিরিয়ে নিতে কাতারের উপর ভর করেছিল। এবং যেই কাতারের মধ্যস্ততায় বিনা রক্তপাতে আমেরিকাকে বের করে দিয়ে তালেবান সরকারকে বসিয়ে দিয়েছে এমন ঐতিহাসিক কুটনৈতিক সাফল্য দুবাই বা সৌদি আরবের মাথামোটা শায়েখরা দেখাতে পারেনি। কাতারের বাহ্যিক কিছু নিন্দনীয় দিক থাকলেও অনেক ভালো ও প্রশংসনীয় কাজ রয়েছে, যা অন্যকোনো মুসলিম রাষ্ট্রের হাতে নেই।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক।