বেঁচে থাকার তাগিদে
1 min read
[কাকলী আক্তার মৌ]
প্রত্যেক মানুষের জীবনে চড়াই-উতড়াই থাকে।ধনী গরিব হয়,গরিব ধনী হয়।আমাদের ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই হয়েছিল।আমার বাবা একজন স্বল্প শিক্ষিত মানুষ।ভাগ্যের লিখনে ধনী-অবস্থাসম্পন্ন কৃষক থেকে রিক্সাচালক হয়েছিলেন। আমি তখন ছোট,স্কুলে পড়ি; ধনী গরিবের পার্থক্য কাকে বলে বুঝি না। কোন সুন্দর জিনিস কারো হাতে দেখলেই বাবার কাছে বায়না ধরতাম;এটা দাও, ওটা দাও।
কখনো কখনো বাবা সেই আবদার রাখতেন, কখনো বা তার জন্য খুব কষ্ট হয়ে যেত।একদিন স্কুলে এক বন্ধুর হাতে সুন্দর একটা খেলনা গাড়ি দেখে বাড়িতে এসে জিদ ধরলাম যে,এরকম একটা খেলনা গাড়ি আমাকে কিনে দিতে হবে।আমার কান্না দেখে বাবা আমাকে নিয়ে দোকানে গেলেন।গাড়ি দেখে দোকানীকে দাম জিজ্ঞেস করলেন।দোকানী বলল, ৫০০/- টাকা। যখনকার কথা বলছি তখনকার সময়ে ৫০০/- টাকা মানে অনেক টাকা।গরিব রিক্সাচালক বাবার কাছে এত টাকা কোথা থেকে আসবে?
গাড়ি আর কিনা হল না।
আমি বাড়িতে এসে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলাম।ঐ দিকে বাবাও অপারগ। আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তখন তিনি একটা নতুন পন্থা বের করলেন। পরের দিন সকালে বাবা বললেন, আজকে তোকে সাথে নিয়ে কাজে যাব। তোর বেড়ানো হবে আর বিকালে আসার সময় খেলনাও কিনে দিব। আমি খুশিতে রাজি হয়ে গেলাম।
বাবা রিক্সা নিয়ে বের হলেন আর তিনি আমাকে তার সামনে বসালেন। কিছুক্ষণ পর একজন যাত্রী রিক্সায় উঠলেন। যাত্রীকে গন্তব্যে পৌছে দেয়ার পর তিনি বাবাকে ৫/- ভাড়া দিল। এভাবে যাত্রী আনা নেওয়া করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। তখন বাবা একটা দোকানের সামনে রিক্সা দাড় করিয়ে আমাকে একটা চকলেট আর কেক কিনে দিলেন আর নিজের জন্য নিলেন একটা বনরুটি ও এক কাপ চা। খেতে খেতে আমি তখন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি যে, বাবার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে আর মুখটা পরিশ্রমে লাল হয়ে আছে। তখন বাবার এমন অবস্থা দেখে আমার মনের মধ্যে অজানা এক কষ্ট অনুভব হতে লাগল।
খাবার খাওয়ার শেষে বাবা আরো কিছুক্ষণ রিক্সা চালালেন। বাড়িতে যাবার সময় যখন হল তখন বাবা আমাকে বললেন, আমি যে টাকা রুজি করেছি সেই টাকায় কি তোর খেলনা হবে? আমি তখন কিছু না বুঝেই বললাম “হবে”। বাবা তখন সারা দিনের রুজি করা সব খুচরো টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন গুনে দেখ; আর মনে রাখিস এই টাকা দিয়ে খেলনা কিনলে তুইসহ আমাদের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।
আমি তখন একটা একটা করে গুনে দেখি যে, সর্বমোট ৬৯/- টাকা হয়েছে। এই টাকা দিয়ে কোন ভাবেই খেলনা কিনা যাবে না।অপর দিকে এই টাকা খরচ করলে আমাদের সবাইকে আজকে না খেয়ে থাকতে হবে।শুধু তাই নয় আমার ঐ খেলনা কিনতে হলে এভাবে কয়েক দিন আমাদের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে। তখন মন খারাপ করে সব টাকা আবার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললাম,বাবা যে খেলনা কিনতে হলে আমাদের সবাইকে তিন বেলা না খেয়ে থাকতে হবে সেই খেলনা আমি চাই না।
বাবার মন বলে কথা, বেশ কিছুদিন পরে অবশ্য তিনি আমাকে সেই খেলনাটাই কিনে দিয়েছিলেন। ততদিনে আমি বুঝে গেছি যে,“অভাবে পরলে অনেক চাওয়া পাওয়া ত্যাগ করতে হয়; বেঁচে থাকার তাগিদে”।
আমার বাবা যদিও স্বল্প শিক্ষিত এইচএসসি পাস একজন মানুষ তবুও বলব, তাঁর কাছ থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছি তা আজ পর্যন্ত কোন কিতাব পড়ে অর্জন করতে পারিনি,পারব কি না তাও অজানা।
আমি কোন সভায় গেলে অভ্যাসবশত একটা বাক্য প্রায়সময়ই বলে থাকি-
Not a colorful book;
I believe, my father is a true super hero and the greatest teacher of my life.
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
আমার আত্মজীবনী থেকে সংকলিত
Kakoli Akther Mou