জাতি গড়ার অক্লান্ত কারিগর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) - Shimanterahban24
March 23, 2023

Shimanterahban24

Online News Paper


Warning: sprintf(): Too few arguments in /home/shimante/public_html/wp-content/themes/newsphere/lib/breadcrumb-trail/inc/breadcrumbs.php on line 254

জাতি গড়ার অক্লান্ত কারিগর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)

1 min read

।। খন্দকার মনসুর আহমদ ।।

লাখো মানুষের অন্তর্লোকে ভালোবাসার তরঙ্গ তোলা একটি নাম আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)। এই মহান আলেমে দ্বীন গত ১৩ ডিসেম্বর বেলা পৌনে ১টায় চিরবিদায় গ্রহণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার গড়া প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় তার শবদেহ আনা হলে শেষবারের মতো তাকে একনজর দেখার জন্য শোকাহত মানুষের ব্যাপক ভিড় জমে। সুশৃঙ্খলভাবে লাইন ধরে হৃদয়ের মানুষটিকে শেষবারের মতো একনজর দেখার এ ধারা অব্যাহত থাকে সারারাত।

পর দিন শীতের সকালে বাইতুল মোকাররমে তাঁর জানাযায় ধর্মপ্রাণ জনতার ঢল নামে। দেশের অসংখ্য আলেম ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার অগণিত ছাত্র কেঁদে কেঁদে অশ্রু ঝরাতে থাকেন। জানাযার আগের রাতে, জানাযা-পূর্ব সমাবেশে এবং দাফনের সময় অসংখ্য মানুষের শোক ও আহাজারিতে বারবার এক করুণ আবহ তৈরি হয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং তার আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ছিল কাসেমী প্রেমিক জনতার ঢল।

তিনি ছিলেন একাধারে দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন, শাইখুল হাদিস, প্রাজ্ঞ ইসলামী রাজনীতিবিদ ও আধ্যাত্মজগতের শাইখে কামেল। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব, নানাবিধ দ্বীনি অবদান ও নীতিনিষ্ঠার কারণে দেশের আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। তার সান্নিধ্যে কেউ অল্প সময়ের জন্য এলেও তার ব্যক্তিত্ব ও উত্তম আখলাকের সম্মোহনে সে বিশেষভাবে সম্মোহিত হতো এবং তার ভালোবাসা অন্তরে নিয়ে ফিরে যেত। তার শিষ্যত্ব লাভকারী আলেম ও তালিবে ইলমরা তো তার জন্য ছিল নিবেদিতপ্রাণ।

[ দুই ]

এই মনীষী ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি রোজ শুক্রবার কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্র। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে লেখাপড়ার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বাবার আন্তরিক ইচ্ছার ফলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। দেওবন্দে ভর্তির সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ায় তিনি সাহারানপুর জেলার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়া সমাপ্ত করে পরের বছর দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। মেধা ও অধ্যবসায়ের ফলে তখনই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি তাকমিল শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন এবং সেকালের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা সাইয়েদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদীর কাছে বোখারি শরিফ পড়েন। তার স্নেহভাজন হিসাবে তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন।

তাকমিল শ্রেণি সমাপ্ত করার পর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আরও ৩ বছর তাখাস্সুস তথা বিশেষজ্ঞতা অর্জনে ব্যাপৃত থাকেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন মাওলানা সাইয়েদ ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী, কারি তাইয়িব, ওহিদুয্যামান কিরানবী, শায়খুল হাদিস জাকারিয়া, মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী, মাওলানা শরিফুল হাসান, মাওলানা নাসির খান, মাওলানা আবদুল আহাদ, মাওলানা আঞ্জার শাহ, মাওলানা হোসাইন বিহারী, মাওলানা নাঈম, মাওলানা সালেম কাসেমী, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রাহ.) প্রমুখ।

[ তিন ]

দীর্ঘ ২৭ বছরের ছাত্রজীবন পার করে নিজ শিক্ষাগুরু মাওলানা আবদুল আহাদের পরামর্শে মুজাফ্ফর নগরে অবস্থিত মুরাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। এটি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী (রাহ.) এর প্রতিষ্ঠিত একটি মাদ্রাসা। সেখানে ১ বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে শরীয়তপুর জেলার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস এবং মুহতামিম পদে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৭৮ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ জামিয়ায় যোগদান করে ৪ বছর অত্যন্ত সুখ্যাতির সঙ্গে শিক্ষকতা করেন।

এ সময় তিনি তার ছাত্র গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্ব ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। তারপর ১৯৮২ সালে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া শরইয়্যা মালিবাগে মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিরমিজি শরিফের অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার পাঠদানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মালিবাগ জামিয়ায় ৬ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৮ সাল থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত দুটি জামিয়ার শায়খুল হাদিস ও মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। এর একটি হলো জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা আর অপরটি হলো টঙ্গির ধউর এলাকায় অবস্থিত জামিয়া সুবহানিয়া মাহমুদনগর।

১৯৮৮ সাল থেকে তিনি বোখারির দরসদান শুরু করেন এবং ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত সেই দায়িত্বে বহাল থাকেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার কাছে হাদিসের দরস গ্রহণকারী শিষ্যরা ছড়িয়ে আছেন। সুদান, কাতার, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার শিষ্যরা বিভিন্ন দ্বীনি খেদমত আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন।

[ চার ]

আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমী (রহ.) কৈশোর থেকেই ইলম ও ইবাদতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে মুরাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকালে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রাহ.) এর কাছে বায়াত হন এবং বিভিন্ন সময় রমজান মাসে তার সঙ্গে ইতিকাফ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রাহ.) এর কাছে বায়াত হন। ১৯৯৫ সালে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রাহ.) বাংলাদেশে আগমন করেন এবং মালিবাগ জামিয়ায় ইতিকাফ করেন। ওই সালেই তিনি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রাহ.) এর খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি খানকায়ে মাহমুদিয়ার আমির নিযুক্ত হন।

[ পাঁচ ]

দেশের প্রতিটি সংকটকালে তিনি তার সুচিন্তিত রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও মতামতের মাধ্যমে ইসলামি রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার প্রয়াস পান এবং তাতে গতি সঞ্চার করেন। তিনি ১৯৭৫ সাল থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। তারপর ২০১৫ সালে এ দলের মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলনে তিনি জোরাল ভূমিকা পালন করেন। তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তী সময়ে বর্তমান সময়ের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগরীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিছুকাল আগে আল্লামা আহমদ শফি (রাহ.) এর ইন্তেকালের পর তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় মহাসচিবের পদে সমাসীন হন। তার সুচিন্তিত রাজনৈতিক মতামত এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তা-চেতনা ইসলামি রাজনীতিতে বিশেষ গতি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে।

[ ছয় ]

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মধ্যে বহুবিধ গুণ ও যোগ্যতার সমাবেশ ঘটেছিল। বর্তমান সময়ে তার মতো ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার বিশেষ গুণ ছিল ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত। যে কোনো কাজের পেছনে তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ব্যক্তিস্বার্থ বলতে কোনো কিছু তার চিন্তায় ছিল না। সে কারণে আত্মপ্রচারের কোনো মনমানসিকতাও তার ছিল না। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সব কর্মেও মানুষ তার এ ইখলাস অনুভব করতে পারত। তিনি সর্বসত্তায় ছিলেন একজন মুখলিস আল্লাহ সন্ধানী সাধক পুরুষ।

তার জীবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল ত্যাগ ও মুজাহাদা। অত্যন্ত ত্যাগ ও মুজাহাদার জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। একদিকে দরসে বোখারির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যদিকে নির্ধারিত আ’মাল, ওযায়েফ ও ইবাদত-বন্দেগি ঠিক রেখেছেন, আবার সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন দ্বীনি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য সফর করেছেন। ইসলামি রাজনীতি ও নানারকম বাতিল ফেরকার বিরুদ্ধেও নানারূপ তৎপরতা চালিয়েছেন। এভাবে অক্লান্ত ত্যাগের সোনালি ইতিহাস রচনা করে তিনি জীবন পার করেছেন।

তার আরও যে গুণটি সমকালীন ওলামায়ে কেরামের মধ্যে খুব স্বীকৃত তা হলো তিনি ছিলেন ছাত্র গড়ার কারিগর। সুযোগ্য ও আদর্শ ছাত্র গড়া এবং সুদক্ষ আলেম তৈরির ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। অমনোযোগী ও হতাশাগ্রস্ত ছাত্রদের তিনি আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে কৌশলে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতেন। আর মেধাবীদের বিশেষ উৎসাহ ও নৈকট্য দিয়ে তাদের মেধা-মননকে বিকশিত করার ব্যবস্থা করতেন পরম দক্ষতার সঙ্গে। তার একজন বিশিষ্ট শিষ্য গবেষক আলিমে দ্বীন মরহুম মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া বলেছিলেন ‘আমার জীবনে ১১৭ জন শিক্ষকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।’

তার গড়া ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন মরহুম মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহিয়া (রাহ.), মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদী (রাহ.), আল্লামা হেমায়েতুদ্দীন আহমদ, ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল গাফফার, মাওলানা হাফেয নাজমুল হাসান, মাওলানা মকবুল হোসাইন, মাওলানা ইকবাল হোসাইন, মুফতি মুহিউদ্দীন মাসুম, মুফতি মুনীর হোসাইন কাসেমী প্রমুখ।

[ সাত ]

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। আজীবন নীতি ও হক আদর্শের ওপর অবিচল থেকে ঈমান ও তওহিদি জনতার পক্ষে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রেখে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। টঙ্গীর ধউর এলাকায় তার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া সুবহানিয়ার গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম উত্তরা, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright © All rights reserved. | Newsphere by AF themes.