স্বাধীনতা রক্ষায় ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে; জমিয়ত
1 min read

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেছেন তাদেরকে আমরা আজকের বিজয় দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তাঁদের বিরত্বগাঁথা ইতিহাস কখনোই ভুলার মত নয়।
আজ (১৬ ডিসেম্বর) বুধবার বেলা ৩টায় পল্টনস্থ দলীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর জমিয়ত কর্তৃক আয়োজিত ৪৯তম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে মাওলানা ইউসুফী এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।
সভায় মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী আরো বলেন, বলা হয়ে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে। কিন্তু আজকে এখানে ২২ হাজার পরিবার হয়ে গেছে, যারা প্রতিনিয়ত শোষণ করে চলেছে। লুটপাট শুরু হয়েছে জনগণের সম্পদ। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও এই দেশের মানবসম্পদ ও আল্লাহর একান্ত রহমতের কারণে এখনো টিকে আছে দেশের মানুষ। না হয় যেভাবে লুটপাট চলছে, একটা দেশ টিকে থাকার কথা নয়। দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা। দেখা গেছে ক্যাসিনো মামলায় যাদেরকে গ্রেফতার করা হল, তাদের কিছুই হয়নি, বরং জেলখানায় রাজার হালে আছেন। এভাবে এক একজন বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না।
মাওলানা ইউসুফী বলেন, এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য সবার আগে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা তো এমন দেশ গড়তে চাইনি, যে দেশের নিয়ন্ত্রণ অন্য দেশের হাতে থাকবে। যে দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অন্য দেশের হাতে থাকবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেশের মানুষের হাতেই থাকতে হবে। আমাদের বিদেশ নীতির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই থাকতে হবে। আমরা চায়না, আমেরিকা বা অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক করতে চাইলে অন্যদেশের তো এই নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার থাকার কথা নয়। আমরা যে দেশের সাথে আমাদের স্বার্থে সম্পর্ক করতে চাইব, সেটা নিয়ে অন্যের কথা বলার সুযোগ কি করে হতে পারে?
মাওলানা ইউসুফী আরো বলেন, কষ্টার্জিত এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক সকলকে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের মানুষের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন করে আসছে। জমিয়ত সবসময় সর্বস্তরে সুবিচার, ইনসাফ ও শক্তিশালী দেশ গড়তেই আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে।
বিশেষ আলোচকের বক্তব্যে জমিয়তের সহসভাপতি শায়খুল হাদীস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সকল মানুষের আশা-আকাঙ্খা ছিল আমরা শান্তিতে বসবাস করব, আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি সংরক্ষিত থাকবে, আমাদের সবকিছুই নিরাপদ থাকবে। কিন্তু ৫০ বছর পার হতে চললেও মানুষের সেসব স্বপ্ন ও আশা এখনো স্বপ্ন হয়েই আছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সর্বত্র হৈ হল্লা হতো যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ পরিবার সব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রিকরণ করতে চাই। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেখা গেল, যারা পর্যায়ক্রমে দেশের দায়িত্ব নিয়েছে, তারা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে বের করে পাচার করেছে। ২২ পরিবার তো লুট করলেও টাকা দেশে রেখেছে। অথচ এখন মহল্লা মহল্লা তৈরি হয়ে গেছে নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কানাডায় বাংলাদেশীদের পাচার করা টাকায়।
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আজকে আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোন এক স্কুলের শিক্ষককে পুলিশ হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মারতে। তখন স্কুলের ছাত্ররা বলে উঠল, আমাদের শিক্ষককে পুলিশ কেন মারবে? আমাদের কি হাত-পা নেই? আমারা কি আমাদের শিক্ষককে মারতে পারব না? পুলিশ কেন মারবে, আমাদের শিক্ষককে আমরা মারব। আজকে আমাদের অবস্থাও এমন হয়েছে যে, পাকিস্তানের ২২ পরিবার কেন আমাদের অর্থ চুরি ও লুটপাট, করবে, আমরা কি লুটপাট-চুরি করা জানি না! উর্দূওয়ালা কেন করবে, আমরাই এটা করব।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, আমাদের স্বাধীনতা আজ যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, আমাদের শিক্ষা পরাধীন, বিবেক-বুদ্ধি পরাধীন, কৃষ্টি-কালচার পরাধীন, চাকুরিও পরাধীন, বিদেশিরা আজ চাকুরির সকল ক্ষেত্র দখল করে নিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই পরাধীন। একটু আগের বক্তব্যে মাওলানা বাহাউদ্দিন সাহেব সুন্দর বলেছেন যে, আমরা কেবল একটা পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছি। আর কিছু পাইনি। সব জায়গাতেই আমাদের পরাধীনতা রয়ে গেছে।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস, বিভিন্ন দিবস এবং পাতাকা নিয়ে চক্কর দেওয়া, আর কিছু নাচগান আর আলোচনা সভা সর্বস্ব এক স্বাধীনতা। মাছ ধরার পলোর ভিতরে মাথা আটকে যাওয়া বোয়াল মাছের লেজ নাড়ানোর মতো স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতার কিছুই অর্জিত হয়নি।
তিনি বলেন, মরহুম কাসেমী সাহেব (রাহ.) বলতেন, এসব সঙ্কটের সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। এটাই বৈধ ও গ্রহণযোগ্য তরীক্বা। এখন আমরা পাঁচ বছর যাবত সরকারের বিরোধীতা করি। দেখা যায়, নির্বাচন আসলে একেক দল এক একভাবে সমঝোতা করে নেয়। তাহলে সরকারের এই বিরোধীতার কী মানে হল? সুতরাং নাগরিকদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুকে রক্ষা করার জন্য, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে জরুরী হল সাংগঠনিক শক্তিকে ব্যাপকতর করা। সংসদে দলের প্রতিনিধি পাঠানো এবং নির্বাচনে শরীক হওয়ার বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য এটাই হল বৈধ ও বাস্তবসম্মত পন্থা। সফল হতে পারলেন কি পারলেন না, সেই প্রশ্নের আগে জুলুম-নিপীড়ন ও লুটপাট বন্ধে কতটা বস্তুনিষ্ঠতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, সেটা নিশ্চিত করাই সর্বাধিক গুরুত্ব।
তিনি বলেন, যদি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সময় ব্যয় না করে মসজিদ-মাদ্রাসায় ও খানকায় নিজের সকল শ্রম ব্যয় করি। আর যদি দেশের রাজনীতিতে ও রাজপথে উলামায়ে কেরামের অংশীদারিত্ব না থাকে, তার মানে চোর-লুটেরাদের হাতে দেশকে ছেড়ে দিলেন আপনি। এটা কি কোন তাক্বওয়া হল? এটা কি দেশপ্রেম হল? মূলত: আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণেও কাজ করে যাব, আবার ইলমে ওয়াহীকে যিন্দা রাখতেও শ্রম দিয়ে যাব। আমাদের আকাবিরদের দুইশত বছরের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা অনুসরণ করবো। এর বিকল্প নিজের তৈরি করা রাস্তায় হাঁটলে মসজিদ-মাদ্রাসাও রক্ষা করা যাবে না, বিদেশিদের যে আগ্রাসন চলছে, তাতে এই দেশের আইন-কানুন ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে যাবে, জাতীয়তা শেষ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দেশ ও দেশের স্বাধীনতা এবং মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর ফেরিয়ে গেল, কিন্ত এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার যে স্বাদ, স্বাধীনতার যে সুফল, সেটি এখনো এ দেশের মানুষ সেভাবে ভোগ করতে পারেনি বা পারছে না। এটি আমাদের শুধু একা বা এক দলের কথা নয়, যারা পর্যবেক্ষক, যারা সচেতন, যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, এ দেশ নিয়ে চিন্তা করেন, স্বাধীনতা নিয়ে যারা গবেষণা করেন, স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে যারা স্টাডি করেন, তাদের সকলের অভিমত এমনটাই যে, আমরা নামের স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কাজের স্বাধীনতা অর্জন করেনি।
মাওলানা আফেন্দী বলেন, স্বাধীনতা বলতে যদি হয় সীমান্তে বার বার আমার দেশের মানুষের লাশ পড়বে। স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার অর্থ যদি হয়, এ দেশের মানুষের জান-মালের কোন নিরাপত্তা থাকবে না, নারী ধর্ষিত হবে, এবং মানুষের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে না, তাহলে স্পষ্ট বলতে চাই, যে উদ্দেশ্যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন সে উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য। এই অর্থবহ করা হল- গণমানুষের মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সংবাদ কর্মীদের নিরপেক্ষতা, সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা এবং সে অনুপাতে দেশ পরিচালনা করা। এসব কিছুই স্বাধীনতার অংশ। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের এগুলো হলো অন্যতম উপাদান। এগুলো যদি কোন রাষ্ট্রে অনুপস্থিত থাকে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি না থাকে, প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে এ রাষ্ট্রকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলা আমি মনে করি অত্যন্ত বেমানান।
তিনি বলেন, এজন্য জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ চায় যে, স্বাধীনতা বলতে যা বুঝি, মুক্তিযোদ্ধরা যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আজকে এই মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আমরা সেই উদ্দেশ্য অর্জনে মনযোগী হবো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।
ঢাকা মহানগর জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মতিউর রহমান গাজিপুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন- দলের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান, অর্থ-সম্পাদক মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা জয়নুল আবেদীন, অফিস সম্পাদক মাওলানা আব্দুল গাফফার ছয়ঘরী, মহানগর জমিয়তের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুফতী বশীরুল হাসান খাদিমানী, মুফতী মাহবুবুল আলম, মুফতী সলীমুল্লাহ, মাওলানা হেদায়েতুল ইসলাম ও যুব জমিয়ত বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরের সভাপতি মাওলানা সাইফুদ্দীন ইউসুফ ফাহীম প্রমুখ।
আলোচনা সভা শেষে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র সাবেক মহাসচিব শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)এর মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দির জন্য বিশেষ দোয়া-মুনাজাত করা হয়। মুনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা মঞ্জুরুল ইলাম আফেন্দী।