যুক্তরাষ্ট্র ও আরব মিত্রদের সৃষ্ট ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন শরণার্থীদের করুণ অবস্থা
1 min read
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সম্প্রতি শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলার মধ্য দিয়ে ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া সংকটের শুরু। বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশ থেকে সন্ত্রাসীদেরকে সংগ্রহ করে সিরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল ওই দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। সিরিয়ার ইদলিব এলাকায় এখনো কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সিরিয়ার সরকার ও তার মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংঘাতের জেরে প্রায় এক কোটি ২০লাখ সিরিয় নাগরিক শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। অনেকে দেশের ভেতরে আবার অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি বলেছেন সাড়ে ৬০ লাখ সিরিয় শরণার্থী দেশের বাইরে অবস্থান করছে।
এদিকে গত প্রায় দুই দশক ধরে ইরাকও যুদ্ধ, সন্ত্রাসী হামলা, বিস্ফোরণ ও তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। যদিও ইরাকি শরণার্থীদের ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয় কিন্তু গত কয়েক বছরের এক হিসেবে দেখা গেছে স্থানীয় অধিবাসীদের উপর আইএস সন্ত্রাসীদের হামলার কারণে ইরাকের ৫০ লাখ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। ইরাকের অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী ইফান ফায়েক বলেছেন, ২০২১ সালের প্রথম দিকে অন্তত ১৫ লাখ শরণার্থীকে নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনা হবে।
২০১৫ সালের ২৬ মার্চ সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের সমর্থন নিয়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এখনো অসম ওই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ওই আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৪০ লাখ ইয়েমেনি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ শরণার্থী ঘরবাড়ি হারিয়ে দেশের ভেতরে অবস্থান করছে।

বলা যায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে যার সংখ্যা হবে প্রায় আট কোটি। সবচেয়ে বেশি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের নাগরিকরা যারা কিনা সারা বিশ্বে মোট শরণার্থীর এক-পঞ্চমাংশের বেশি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে দায়ী হচ্ছে পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন নীতি এবং আরববিশ্বে তাদের সেবাদাস সৌদি আরব।
যেকোনো শরণার্থী পরিস্থিতি ওই দেশটির জন্য যেমন সংকট সৃষ্টি করে তেমনি প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের জন্যও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরণার্থীরা ওই দেশটির ভিতরে ও অন্যান্য দেশেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাদবাকি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। বিশেষ করে খাদ্যসংকট সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। এ কারণে শরণার্থী কবলিত এলাকায় লাখ লাখ মানুষের জন্য জরুরী খাদ্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এ দুঃসহ পরিস্থিতি দেখা যায় ইয়েমেনিদের ক্ষেত্রে। ইয়েমেনে তীব্র খাদ্য সংকটের পাশাপাশি পরিধানের জন্য পোশাক এবং খাদ্যপানির মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধ কবলিত সিরিয়ায় যারা শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে তাদের অধিকাংশই লেবানন, তুরস্ক ও জর্দানের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে দিনযাপন করছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শরণার্থীদের অনেকে উগ্র গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে যার ফলে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিরিয়া ও ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থিত শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে আছে। বিশেষ করে তারা চর্মরোগে ভুগছে। কারণ সময়মতো গোসল না করা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে না পারা, অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে বাধ্য হওয়া, খাদ্য ও পানির অভাব প্রভৃতি কারণে তারা চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভুগছে। এইসব শরণার্থীদের একটা বড় অংশ হচ্ছে নারী ও শিশু যারা অত্যন্ত অমানবিক জীবন যাপন করছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় সেনা সদস্যদের মাধ্যমে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের মতোই শরণার্থী তরুণীদেরকে ধরে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের অনেককে কেউ কেউ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে আবার অনেককেই দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে শরণার্থী জীবন যাপন করায় শিক্ষাদীক্ষা থেকেও শরণার্থী শিশুরা পিছিয়ে পড়ছে। শরণার্থীদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৭ বছরের নিচে। শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ার কারণে এসব শরণার্থী শিশুরা নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে অক্ষম হয়ে পড়ছে। বছরের পর বছর এভাবে বেড়ে ওঠায় তারা নিজেদের অধিকার বিষয়েও সচেতন হতে পারছে না।
শরণার্থীরা যেমন নিজের দেশে সংকট সৃষ্টি করে তেমনি প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের জন্যও সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ শরণার্থীরা ঘরভাড়া নেওয়া, খাদ্যের দাম দেয়া কিংবা পানি ও বিদ্যুতের মত অন্যান্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় জনগণের উপর এবং তারাও দুর্ভোগের শিকার হয়। এ কারণে লেবানন ও জর্দানের সরকার সেদেশে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ার শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সিরিয় শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দেয়ার ফলে সেদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি এসব শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে সহযোগিতা করার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও শরণার্থীরা কঠিন চ্যালেঞ্জ বা বিপদের সম্মুখীন। কারণ অনেক সময় শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি সিরিয়া শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের অনেকে কোনো কোনো দেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন।
লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক সমাজের সদিচ্ছার অভাবে শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছে না। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে কোনো কোনো দেশ শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করায় তিনি এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সিরিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আইমান সুসানও বলেছেন, সংযুক্ত আমিরাত প্রথমে সিরিয়া শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও মার্কিন চাপের কারণে তিনি ওই সম্মেলন শেষ পর্যন্ত বর্জন করেন।
প্রকৃতপক্ষে, শরণার্থী বিষয়টি বর্তমানে রাজনৈতিক চাপ ও দরকষাকষির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তুরস্ক সরকার শরণার্থীদেরকে সিরিয়ায় ফেরত দেয়ার পরিবর্তে ইউরোপকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে তারা যদি তুরস্ককে সমর্থন না করে তাহলে শরণার্থীদেরকে ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবও শরণার্থীদেরকে নিজ দেশে ফিরে যেতে সহযোগিতা করার পরিবর্তে এদেরকে হাতিয়ার করে সিরিয়ার কাছ থেকে যতটা সম্ভব ছাড় আদায়ের চেষ্টা করছে। এরফলে শরণার্থীদের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। সূত্র: পার্সটুডে।