কর্নেল হাটে ‘কর্নেল’ নেই আছে তাঁর স্মৃতিময় কুটির
1 min readবিশেষ প্রতিনিধি, উখিয়া :: “অন্য জায়গা হলে এটা তীর্থ ক্ষেত্র হতো। আমাদের চট্টগাম বলে হয় নাই। ”
শামসুল হোসাইন
‘কর্নেল জোনস সাহেবের নামে গড়ে ওঠে কর্নেলহাট। উনি খুব মিশুক ছিলেন। আশেপাশের লোকের সঙ্গে ওনার মেলামেশা ছিল। সেই সুবাদে ওনার নামটা এখানে যুক্ত হয়েছে। আর এখানে সমুদ্র পর্যন্ত সড়কটিও কর্নেল জোনসের নামে। এই এলাকায় তাঁর বাসভবনের নাম ছিল ‘কর্নেল কুটির’।’
কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক মো. আমানত উল্লাহ মাস্টার এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন। এসবই তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি। ২০০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি অবসর নেন। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে নগরের প্রবেশদ্বার খ্যাত কর্নেলহাট গড়ে উঠেছে ইংরেজ নাগরিক কর্নেল স্যার উইলিয়াম জোনসের নামে।
পেশায় যিনি ছিলেন বিচারক। কর্মক্ষেত্র ছিল কলকাতা। কিন্তু চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে তিনি এখানকার পাহাড় চূড়ায় প্রকৃতির কোলে গড়ে তোলেন একটি বাংলো। ‘কর্নেল কুটির’ নামেই যেটি সবার কাছে পরিচিতি পায়।
আজ কর্নেল জোনস নেই। আছে তাঁর স্মৃতির নিদর্শন সেই বাড়িটি। কিন্তু সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ প্রজন্মের অনেকেই চেনেনা তাঁকে। তাই ইতিহাস গবেষকেরা তার পরিচয় তুলে ধরা এবং
বাড়িটি সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন।
কর্নেল হাট গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে আমানত উল্লাহ মাস্টার বলেন, ‘তখন জোলারহাট ছিল নামকরা বাজার। কিন্তু একবার মহররমের সময় আমাদের গ্রামের মকবুল নামে একজন লোক জোলারহাটে মারা যায়। উনি ছিলেন আমার আত্মীয়। এ ঘটনার পরে আমরা জোলারহাট বর্জন করি এবং এখানে গড়ে তুলি কর্নেল জোনসের নামে কর্নেলহাট। এখনো পর্যন্ত আমরা আর জোলারহাট যাই না। এখানেই আমাদের বাজার সারি।’
মোকাররম হোসেনের লেখা ‘নামকরণের নেপথ্যে’ শীর্ষক নিবন্ধেও বলা হয়েছে, কর্নেল উইলিয়াম জোনস ‘কর্নেল হাট’ স্থাপন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি কিউরেটর, ‘ইটারন্যাল চিটাগাং’ গ্রন্থের লেখক শামসুল হোসাইন বলেন, ‘ওনার (স্যার উইলিয়াম জোনস) একটা প্রিয় জায়গা ছিল চট্টগ্রাম। উনি বার বার চট্টগ্রামের নাম উচ্চারণ করতেন। ওনার লেখাতেই আছে সেই ‘চাটিগাঁও’-র কথা। এ নামই তিনি উচ্চারণ করতেন। এই চাটিগাঁর কর্ণেলহাট এলাকার একটা জায়গায় তিনি একটা বাড়ি করেছিলেন। এটার প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ‘ক্যাপ্টেন ফক্সনস’ ডিউরিং আ ট্যুর টু চাটিগাঁও’-এ বইটাতে। এটি এখন মন্দির এলাকার ভেতর ।’
সরেজমিনে কৈবল্যধাম মন্দিরের ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় ‘কর্নেল কুটিরে’ গিয়ে দেখা যায়, এটি একটি বিচ্ছিন্ন পরিত্যক্ত বাড়ি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাটিতে। বাড়িতে ওঠার মুখে রয়েছে মন্দিরের গেট। তালা দেয়া। সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই। আবর্জনার স্তুপ গেটের আশে পাশে। সেই আবর্জনা মাড়িয়েই দেয়াল টপকে ওপারে যেতে হয়। পাহাড়ে মাটি খসে পড়ছে। আগে বাড়িতে ওঠার সিঁড়ি জায়গায় রয়েছে সিমেন্টের জমানো সরু আকৃতির থাম। তাও উল্টে পাল্টে আছে। বাংলোর কাছাকাছি এসে চোখ জুড়িয়ে যায়। চারপাশে সবুজের বিস্তীর্ণ মাঠ। বড় বড় গাছপালা। এরমধ্যেই একপাশেই রয়েছে একটি দেড় তলা বাড়ি। দরজা-জানালা নেই। কিন্তু মূল কাঠামো বেশ শক্ত। ভেতরে বড় বড় কক্ষ। কক্ষগুলোতে অবস্থান করছে বড় বড় কয়েকটি গয়াল। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে দেখা যায়, সেখানোও রয়েছে বসার ব্যবস্থা। ছাদের সীমানা দেয়ালে রয়েছে কারুকাজ। ছাদে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সমুদ্র উপকূলের দৃশ্য। নিচে মূল বাড়ির সামনে ছোট একটি স্থাপনা রয়েছে। হয়ত এখানে বসেই চলতো অলস সময় উপভোগ, বিকেলের আড্ডা।
স্যার উইলিয়াম জোনস সম্পর্কে শামসুল হোসাইন বলেন,
‘তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের জজ। বাংলায় যখন কোম্পানি শাসন চালু হলো, যখন হাইকোর্ট হচ্ছে তখনকার প্রথম যুগের জজ হিসেবে বিলেত থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। এটা ওনার বড় পরিচয় নয়, ওনার বড় পরিচয় হচ্ছে, এশিয়া অঞ্চলে আধুনিক ধ্যান-ধারণা, বিজ্ঞান চিন্তার পথিকৃৎ হিসেবে। কলকাতা শহরে এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের কাজে উনি ছিলেন প্রথম উদ্যোক্তা।’
কর্নেল কুটিরের গুরুত্ব তুলে ধরে শামসুল হোসাইন বলেন, ‘এটা সংরক্ষণ করা উচিত। এটা কার বাড়ি এটাও তো কেউ ধারণা করতে পারছেনা। স্যার উইলিয়াম জোনস কে। এগুলো জানেনও না সবাই। মানুষ জানেনা মানে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এগুলো রাখা উচিত। অন্য জায়গা হলে এটা তীর্থ ক্ষেত্র হতো। আমাদের চট্টগাম বলে হয় নাই। এটা কালচারাল টুরিজমের অংশ।’