বাঙ্গালী গুজবেরও জাতি
1 min read[শাহিদ হাতিমী]
বাছবিচার ছাড়া যাচ্ছেতাই গ্রহণের যেনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে বাঙালিরা। কেউ একজন বললো তেজপাতা আর আদা দিয়ে রঙ চা পান করলে করোনা সরে যাবে! ব্যস, রাত ৩টায়ও ঘুম থেকে জেগে বাঙালিরা রঙ চা পান করলো। কোথাকার কেউ একজন বললো রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে রাস্তায় দাড়িয়ে আজান দিলে করোনাসহ সকল মহামারী পলায়ন করবে! ব্যস, বাঙালিদের ঠেকায় কে? নারী পুরুষ বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়, ভুলেশুদ্ধে দিতে থাকলো আজান। সেদিন শুনলাম আমার আম্মাকে একজন এসে বলছে ওগো- তুমি তো কুরআন তেলওয়াত করো সবসময়, তয় একটা খবর হচ্ছে ভাগ্যবানদের কুরআন শরীফের ভেতর চুল পাওয়া যাচ্ছে, আর ঐ চুল ভিজিয়ে যাঁরা পানি পান করবে তাদেরকে কখনো করোনায় আক্রান্ত করতে পারবে না! আম্মা আমার দিকে তাকান, আমি মুচকি মুচকি হাসি! আম্মা যা বুঝার বুঝে নেন! তবে বিষয়টা পরদিন আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা আমার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলে আমি বললাম এসব গুজব! কিন্তু মহিলা আমার কথায় সন্তুষ্ট হননি। তিনি বরং তাঁর নাতীকে ডেকে বললেন, দেখতো আমার বড় কুরআন শরীফের কোথাও গাইবি চুল আছে কি না!! তাই দুইদিন থেকে ভাবছি, বাঙালিরা শুধু বীরের জাতি নয়, বরং গুজবেরও জাতি। যা গিলার নয় তাও গিলে খায়! অসম্ভবকেও সম্ভব করতে দ্বিধা করে না।
একটি মজার তথ্য মনে পড়ছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লিখেন- লর্ড ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখেছিল নবাবকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ‘অপমান করতে করতে’ তখন দাঁড়িয়ে থেকে যারা এসব প্রত্যক্ষ করেছিল, তারা যদি একটি করেও ঢিল ছুড়তো তবে ক্লাইভকে করুণ পরাজয় বরণ করতে হতো। আরো চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক এবং অসংখ্য কামান-গোলাবারুদসহ বিশাল সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী নিয়েই পলাশীর ময়দানে এসেছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। কিন্তু তার বিপরীতে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩ হাজার, যার মধ্যে ৯শ জনই ছিলো হাতেপায়ে ধরে নিয়ে আসা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শৌখিন অফিসিয়াল সদস্য, যাদের অধিকাংশেরই তলোয়ার ধরার মতো সুপ্রশিক্ষণ ছিলো না, কোনোদিন এই লালচামড়ারা যুদ্ধও করেনি।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে যখন গ্রেফতার করে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অসংখ্য মানুষ হা করে নিরব দর্শকের মতো সেই দৃশ্য উপভোগ করেছিলো। শুধু তাই নয়, পিঠে ছুরিকাঘাত করার পূর্বে নবাবকে কাটাওয়ালা সিংহাসন ও ছেঁড়া জুতা দিয়ে যখন অপমান করা হচ্ছিলো, তখন শত শত বাঙালী মানুষ সেই কৌতুকে ব্যাপক বিনোদিত হয়েছিলো! সাইকোলজিটা একটু খেয়াল করে দেখুন, এই জাতি দুইশো বছরের গোলামী সাদরে গ্রহণ করেছিলো ঠিক এভাবেই।
এতো কিছু জেনেও রবার্ট ক্লাইভ যুদ্ধে নেমেছিলো এবং জিতবে জেনেই নেমেছিলো। কারণ, রবার্ট ক্লাইভ খুব ভালো করেই জানতেন একটি হীনমন্য, ব্যক্তি স্বার্থলোভী, পরদোষ চর্চাকারি ও দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে পরাস্ত করতে খুব বেশি আয়োজনের প্রয়োজন নেই; রক্ত-যুদ্ধ এইসব এদের জন্য মশা মারতে কামান দাগার মতো অবস্থা। যাদেরকে সামান্য দাবার চালেই মাত করে দেয়া যায়, তাদের জন্য হাজার হাজার সৈন্যের জীবনের ঝুকি তিনি কেনো নিবেন? এছাড়াও, মীরজাফরকে যখন নবাবীর টোপ গেলানো হয়, রবার্ট ক্লাইভ তখনো জানতো যে, সিরাজকে পরাজিত করারপর এই বিশ্বাসঘাতকসহ বাকিগুলোর পাছায়ও লাথি দেয়া হবে এবং হয়েছেও তাই! মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, ঘষেটি বেগমসহ সবগুলোরই করুণ মৃত্যু হয়েছিলো।
রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরের বেইমানীর উপর ভরসা করে যুদ্ধে আসেনি! সে যুদ্ধে এসেছিলো বাঙালীর মানসিকতা ও ভূত-ভবিষ্যতসহ বহুদূর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে আন্দাজ করে। সে জানতো, মীরজাফরকে টোপ দিলে গিলবে এবং কাজ শেষ হলে লাথি দিবে। সে জানতো, যুদ্ধশেষে জনসম্মুখে নবাবের পাছায় লাথি দিলেও এই জাতি বিনোদনে দাঁত কেলাবে, অথবা হা করে সব চেয়ে চেয়ে দেখবে। বিনা দ্বিধায় আমরা দখল করতে পারবো বাঙলা মুলুক।
আসলে আমাদের রক্ত দূষিত, সমাজে ভালো লোকের সংখ্যাই বেশি । খারাপ মানুষ খুব অল্প, তারপরও আমরা পুরো জাতি এই গুটিকয়েক খারাপ মানুুষের কাছে জিম্মি! এই খারাপরা অতি অপকৌশলে নানান গুজব বাজারে ছেড়ে দেয়! আর আমরা বাঙালিরা সরল কানে তা বিশ্বাস করে নেই! স্বার্থের বিনিময়ে খারাপরা যা বলছে ভালোরা দেদারছে তা গ্রহনও করছেন!! কেন? আসুন না, একটা শ্লোগান তুলি “খারাপকে ভালো করি, সমাজকে সুন্দর করি”! গুজবকে না বলি। মিথ্যা ও গুজবকে এড়িয়ে চলি! আর কোন খারাপ যদি এ মিছিলে না আসে, তবে এই নব্য মীরজাফরদের লাথি দিয়ে দেশছাড়া করি! প্রস্তুত তো?
লেখক: খ্যাতিমান কলামিস্ট, সম্পাদক- পুষ্পকলি, শিক্ষক- দারুল আজহার সিলেট।