“যেমন ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হান্নান রহ.শায়খে পাগলা”
1 min readজীবন দর্শন
‘সাইদুজ্জামান আল হায়দার’
সুনামগঞ্জে অদ্যাবধি যত ইসলামি মনীষী জন্ম নিয়েছে,তার মধ্যে অন্যতম হলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হান্নান রহ. শায়খে পাগলা। তিনি ইলমে জাহির ও ইলমে বাতিনের সম্রাট ছিলেন। ছিলেন উভয় ইলমের পূর্ণ জা’মে ব্যক্তিত্ব। এমন ক্ষণজন্মা নিরব বিপ্লবী রাহবার সমকালে খুব কমই ছিলেন।জানিনা আগামীতে তাঁর মতো কারও জন্ম হবে কি না । একসাথে ইলমে জাহির ও ইলমে বাতিনে পারদর্শী ও পাণ্ডিত্য অর্জন করা বড়’ই দূরূহ ব্যাপার।যার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন। অন্য মনীষীরা কেউ ইলমে বাতিনের সম্রাট, কেউ ইলমে জাহিরের সম্রাট।খলিফায়ে মাদানি মাদফুনে মক্কী শায়খে গাজীনগরী রহ.,শায়খে সৈয়দপুরী রহ.,শায়খে কাতিয়া ও শায়খে রাজাপুরী রাহিমা হুমুল্লাহু তায়ালা -এসকল বুজুর্গের পর সুনামগঞ্জে বাতিলের জম হিসেবে আন্দোলন – সংগ্রামে প্রধান সেনাপতি হিসাবে আব্দুল হান্নান রহ. এর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি একাধারে নববী আখলাকের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, আকাবীর ও আসলাফের অবিকল মডেল, সাহাবা আদর্শের অাইডল,সরল পথের মিনার, দৃঢ় সংকল্প আর হিম্মতের অটল পর্বত, ভ্রষ্টতার অাঁধারে আচ্ছন্ন সমাজে প্রদীপ্ত মশাল,আহলে হকের বাতিঘর, তাকওয়া ও তাজকিয়ায়ে নাফছের মূর্তপ্রতিক।তিনি একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি বিপ্লব, দেওবন্দীয়তের অনুপম আবিষ্কার, সর্বোপরি ইলমে হাদীসের এক কিংবদন্তি খাদেম। আন্দোলন ও সংগ্রামের বীর সিপাহসালার। আমৃত্যু তাহাজ্জুদ নামাজের পাবন্দ ছিলেন। অধমের নিকট হজরতের খাছ শাগরিদে রশিদ শায়খুল হাদীস মুশাহিদ আলী সাদিপুরী রাহ.বর্ণনা করে তিনি বলেন – আমার তালীমি মুরব্বি শায়খে পাগলা রাহ. কে দ্বীনের প্রতিটি মাসাইল তথা এ’তেকাদিয়্যাত,মুয়ামিলাত,মুয়াশারাত,আখলাকিয়্যাত ও ইবাদিয়্যাতে বেনজির পেয়েছি। বিশেষকরে তাহাজ্জুদ নামাজে নিয়মিত অভ্যস্থ পেয়েছি। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি একাধিকবার সফর থেকে এসে হজরত রাত বারোটার পরে ঘুমিয়েছেন কিন্তু রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ, তিলাওতে কুরআন, মোরাকাবা ও দোয়া করে ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করে দিবসের আমল শুরু করেছেন।ইন্তেকালের সপ্তাখানিক পূর্বে ধার্মিক বিজ্ঞ ডাক্তার হজরতকে বললেন,আপনি রাত্রি জাগরণ কয়েক দিনের জন্য ছেড়ে দিন। যারা হজরতের খেদমতে সাথে ছিলেন তাদেরকেও বললেন,আপনারা হজরতকে সিরিয়াসলি বুঝান! কিন্তু কার সাহস আছে হজরতকে বলবে আপনি কিছু দিনের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ ছেড়ে দিন। অবশেষে তারা পরামর্শ করে হজরতের মুশফিক ছাত্র মুফতি শফিকুল আহাদ হাফিজাহুল্লাহ এর মাধ্যমে হজরতকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে,যারা নিয়মিত সরকারি চাকরি করে তারা নির্ধারিত সময় হলে চাকরি না করলে ও তারা পেনশন পায় ঠিক তদরুপ আপনি ও আজীবন তাহাজ্জুদ পড়েছেন এখন না পড়লেও তাহাজ্জুদের ছুয়াব পাবেন। উত্তরে হজরত বললেন,এটাতো দুনিয়ার সরকারের নিয়ম। অধম হজরতের কোন ছাত্র নয় কিন্তু হজরতকে বিভিন্ন সময় কাছ থেকে দেখার কারণে হজরতে প্রতি ছিল নিরন্তর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।হজরতকে দেখেছি,সুন্নত মুতাবিক বসে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পনের মিনিট পর্যন্ত বাকায়দা বাওজু দরস দিতে। দেখেছি, সবসময় কিতাব মুতালাআ করতে এমনকি অর্ধ কিলোমিটার রিকশা যোগে সফর কালিন সময়ে ও হজরত কিতাব মুতালাআ করতেন। তিনির নিজ জনপদের আশপাশের প্রায় সব ওয়াজ মাহফিলে হজরত সভাপতি থাকতেন। এবং যেতেন সাথে একটি ব্যাগ থাকতো তার ভিতরে অন্য বস্তুর সাথে একটি কিতাব অবশ্যই থাকতো। আসলেই তিনি অনন্য, বরেণ্য ও ঈর্ষণীয়। দেখেছি শায়খের সিংহের মত গর্জন। তাঁর সাহসিকতার একটি ঘটনা মনে পড়ল।২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ফজলে রাব্বি স্বরন এর নেতৃত্বে তার গ্রাম দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের উজানি গাঁও এর মাঠে বিশাল যাত্রাগাণের আয়োজন করে পোস্টার, পেন্ডাল ও গাইকা বোকিংসহ যাবতীয় কাজ শেষ করার পর প্রতিবাদ সভায় তৌহিদি জনতাকে সিংহের মত গর্জে উঠে শায়খ রাহ.বলেন – আমার শেষ রক্ত থাকা অবস্থায় ঐ স্থানে হারাম কাজ হতে দিব না।দেখেছি শায়খের বিরল সৎসাহস। উপরে উল্লেখিত গানের প্রতিবাদে মাইকিং হচ্ছিল। পুরো দক্ষিণ সুনামগঞ্জে মাইকিং এর নির্ধারিত গাড়ি যখন শান্তিগঞ্জের পুলিশ ফাঁড়ির নিকট মাইকিং করে আসলো হঠাৎ করে ওসির নির্দেশে গাড়ি ও মাইক পুলিশ জব্দ করলো। ঘটনাক্রমে শায়খ খবর পেয়ে একা ওসির রুমে ঢুকে লাঠি দিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,মাইক ও গাড়ি ছেড়ে দেন নতুবা দেখ ঐ লাঠি? আজ আর তুমার রক্ষা নাই। আলহামদুলিল্লাহ।সে গাড়ি ও মাইক ছেড়ে দিল।জেনেছি শায়খের তাকওয়া কথা। মৃত্যুর পরে বাদ এশা চেহারা মোবারক দেখে শায়খের কবর কোথায় তার উত্তরাধিকারী গণকে জিজ্ঞাসা করলাম? তারা উত্তরে বললেন, হজরত মৃত্যুর পূর্বে ওসিয়ত করে গেছেন মাদরাসার ওয়াকফকৃত স্থানে যেন তাকে কবর না দেয়া হয়। কেননা এটা মাদ্রাসার স্থান এটা আমার নিজস্ব জায়গা নয়।তাই সাবধান!অামাকে মাদরাসায় দাফন করিওনা তবে মাদ্রাসার ময়দানে জানাজা র নামাজের আয়োজন করিও অন্য কোথাও নয়।বিধায় উভয় মাসআলা হজরতের ওসিয়ত মোতাবেক সম্পাদন করা হয়। মোদ্দাকথা হচ্ছে হজরত রাহ. আপাদমস্তক আল্লাহর ওলী ছিলেন। হাজার হাজার ছাত্র হজরতের কাছে বুখারী শরীফসহ অন্য কিতাব পড়ে ধন্য হয়েছে। এদের অনেকাংশ শায়খুল হাদীস, মুহাদ্দিস, মুফতি, মুফাসসির,ওয়াইজ,মুবাল্লীগ,মুয়াল্লিম, মুয়াজ্জিন, রাজনীতিবিদ,শায়খুল কুররা,কারী,লেখক,সম্পাদক, গবেষক, সাংবাদিক ও ব্যাবসায়ী হিসেবে খেদমতে খালক করে যাচ্ছে। সিলসিলাতুর রিজাল আল মুসিলাতু ইলাল মতন হিসাবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে হজরতের ইসিম মোবারক সনদে হাদীসে তা কিয়ামত লিখা থাকবে।দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলায় জন্ম নেয়া কীর্তিমান এই মনীষী ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। অসীম দয়াময় আল্লাহর কাছে আমরা এই বুজুর্গের দরজাত বুলন্দির আকুল প্রার্থনা করছি। আমীন, ছুম্মা আমীন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও রাজনীতিবিদ।